আলতা, পাখি ও পাখিওয়ালা || সাকিব শাকিল

 


আলতা, পাখি ও পাখিওয়ালা


সারাবাড়ি তন্য তন্য করে খুঁজেও কোনো আলতা পাওয়া গেল না। কার পায়ে চুরি হয়ে গেছে আমাদের আলতা নাকি কোনো আলতা চুরি করে নিয়ে গেছে আমাদের পা। এমন ভাবনার দিনে একটা পাখি ডেকে ডেকে নিজেকেই রক্তাক্ত করে ফেলে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। পাশের ঘরে কে যেনো বিনুনি করে কাঁদে। আমার হৃদয়টা হুড়মুড় করে ওঠে। কোথাও ঝড় হচ্ছে? বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঘরে ফিরছে কানাকুয়া। এই পাখি ডাকলে নাকি মৃত্যু হয় প্রিয়জনের। মা বলেন, বৃদ্ধা আঙুল আর কেনি আঙুল চাপ দিয়া ধরে থাকো। জামানা ভালো না। কার যেন কি ক্ষতি হয়ে যায়। লবণ দিয়ে সিন্নি বিলাবো এই রাতটা পার হোক।

আমি বৃদ্ধাঙুল চাপ দিয়া ধরে থাকি রাতভর। ঘুমের ভেতরেও শক্ত করে ধরে রাখি। আর আমার ঘুমের ভেতর সব স্বপ্ন দেখি আলতার মতো রঙিন হয়। সবকিছু আলতা আলতা রঙের মতো লাগে। সারাবাড়িতে আলতা খুঁজে না পাওয়ার চিন্তা দেখি স্বপ্নের ভেতরেও অস্থির হয়ে ওঠে। সারাটাবাজার থেকেও নাকি আলতার কৌটা হারিয়ে গেছে, শোক সংবাদের মতো এমন ঘোষণা দেয়া হচ্ছে আমাদের মহল্লাজুড়ে।


লোহার দা দিয়াও থামানো গেলো না সেই ঝড়কে। হিন্দুপাড়া থেকে উলুধ্বনির আওয়াজ আসে। নুপুরের দাদা উঠানে দাঁড়িয়ে দেয় আজান। ঝড় থামে না। খোদার এমন বিগার এ মহল্লার কেউই কখনো দেখে নাই। নুপুরের মা বলে খোদার বিগার উঠছে রে খোদার বিগার।

কি নাফরমানি কথা! তারে চুপ থাকতে বলে সবাই, যেন খোদা আরো রাগ না করে। এমন বৃষ্টি আমি কখনোই দেখি নাই। বৃষ্টির রঙতো কখনো আলতার মতো হয় না কিংবা আলতার রঙ হয়না কখনো বৃষ্টির মতো । তাহলে আমাদের বাড়ি ও বাজারের সকল আলতা কি আকাশে উঠে গেছে!

তবু মনে হয়—না, আলতা হারিয়ে যাই নি। সে হয়তো এই ঝড়ে কোথাও লুকিয়ে আছে একা একা। কিংবা কোথাও লুকায়নি আলতা শুধু মনে মনে ভাবছে 'আমি লুকিয়ে গেছি' আর সেই থেকেই বাড়ি ও বাজার থেকে আলতাগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। আলতা কি কোনো কানাকুয়া যে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ভুলে গেছে হাজীবাড়ির দরজার ঠিকানা আর একা একা কেঁদে যাচ্ছে পাশের ঘরে বিনুনি করে কান্না করার মতো।


মা এই পাখিকে বলে কোৎ পাখি। সারারাত সে ডাকে কোৎ, কোৎ।

আমার ভয় করে। আমার ঘুমের ভেতরেও এমন একটা কোৎ পাখি ডাকে। পাখিটা কি জেনে গেছে আলতা নিঁখোজের সংবাদ। আলতার মৃত্যু হবে জেনেই কি পাখিটা এই ঝড়ের রাতে কোৎ কোৎ শব্দ করে ডেকে যাচ্ছে অবিরাম।


এমন ভাবনার দিনে আমার সেই পাখিওয়ালাদের কথা মনে পড়ে । যারা কাঁধে করে রঙবেরঙের পাখি নিয়ে প্রবেশ করতো আমাদের মহল্লায়। আমরা খাঁচার পাখির সাথে গল্প করি। পাখি তুমি কি জানো আমাদের বাড়ি থেকে আলতা নিঁখোজ হয়ে গেছে। আমাদের বাজার থেকে আলতা নিঁখোজ হয়ে গেছে। পাখিরা কথা বলে না। শুধু শব্দ করে কোৎ কোৎ। আমরা পাখিওয়ালাদের সন্দেহ করা শিখে যাই। আলতা নিঁখোজের পেছনে হয়তো এই পাখিওয়ালাদের যোগসূত্র আছে। সারাটা আকাশজুরে এমন ষড়যন্ত্রময় বাতাসে এমনই একটা আবাস দিয়ে যায় আমাদের। আমরা সকলেই সন্দেহের চোখ দিয়ে পাখিওয়ালাদের দিকে চেয়ে থাকি। আমাদের নিঁখোজ হওয়া আলতার খবর বলে দেও পাখিওয়ালা। পাখিওয়ালাদের ভূতুরে চোখ আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। তারা ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে পালিয়ে যায় মহল্লা ছেড়ে।


মানুষ পালিয়ে কতদূর যেতে পারে পৃথিবীর পথে ? আমরা শুনেছি যেইসব পাখিওয়ালারা যেদিন পালিয়ে গেছে তাদের স্বপ্নের ভেতরেও নাকি বটগাছ তৈরী হয়। সেই বটগাছের রঙ আলতার রঙের মতো রঙিন। তার উপর উড়ে বেড়ায় রংবেরঙের পাখি।

এমন একটা বিষয় স্বপ্ন হতে পারে নাকি দুঃস্বপ্ন তা কোনো পাখিওয়ালাই বুঝে উঠতে পারে না। তারপর তারা অনেককাল শুধু জেগে থাকে। আর মহল্লার সকল মানুষকে দেখে ভূত ভূত বলে দৌঁড়ে পালায়।


সীমানার এই পৃথিবীতে পালানোর পথ নেই মানুষের। স্বপ্নের ভেতর  এমন সব দার্শনিক কথারা ঘুরে বেড়ায় আমার ঘরে, বিছানায়, ঘুমের ভেতরে। যেনো দলবেধে মৃত মানুষের পাশে মাদ্রাসার ছাত্ররা এই কথাটাই তেলাওয়াত করছে বারবার। আর পাশের ঘর থেকে আওয়াজ আসে বিনুনি করে কান্না করার মতো।

ঝড়ের মধ্যও পাখিটা ডেকে যায় কোৎ কোৎ। 

_____________________________________________