আবদুর রহিম ও একটা সত্য || সাকিব শাকিল

 


আবদুর রহিম খুব সতর্কভাবে চলে কিছুদিন। যেন সে একটা ছায়া। মানুষের মাঝে থেকেও কেউ তাকে ধরতে পারে না। সবকিছু তার কাছে ষড়যন্ত্রময় মনে হয়। খুব সন্তর্পণে সে হাঁটে, কথা বলে, সকল ষড়যন্ত্রের ভেতর সে একটা হাওয়ার রুপ ধারণ করে বাঁচে। সব দরজার কাছেই সে করাঘাত জাগায় কিন্তু সেখানে কোনো শব্দ হয় না। ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে এসে হাসিমুখে তাকে অভিবাদন জানায় না। তার হাসির কোনো শব্দ নেই, তার কান্নার কোনো শব্দ নেই, তার চিৎকারেরও কোনো শব্দ নেই। কথা বলার মতো তার কোনো ভাষা নেই, পৃথিবীর অনুভূতিশূন্য এক মানুষে পরিণত হয়ে যায় আবদুর রহিম।


ঈদে অনেকেই অনেক কাজে বাড়ি আসে। কেউ আসে জমিজমা ঠিক করতে, কেউ আসে গরু কুরবানি দিতে, কেউ আসে-এবার সমাজ থেকে কাকে বাদ দেয়া যায়, কাকে সকলে মিলে এক হয়ে অপমান অপদস্থ করা যায়। 

আবদুর রহিমের এসবের অনেক কারণেই ভয় হয় অথচ সে কোনো অন্যায় করেনি। কারো জমি অবৈধভাবে ভোগ দখল করেনি, কারো মেয়ের বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য কূটচালও চালেনি। সে নামাজ পড়ে তবে নিয়মিত না, মাঝে মাঝে তাহাজ্জুদও পড়ে, রাতে নিরবে কান্নাকাটি করে। দুইবছর আগেও সে নিয়মিত ঈদুল আযহায় গরু কুরবানি দিত। এখন দিতে পারে না। 'আল্লাহ কুরবানি দেয়ার মতো তৌফিক দেই নাই' এই বলে সে নিজেকে মনে মনে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু আবদুর রহিমের মন শান্ত হয় না। কি যেন এক অস্থিরতায় তার ভেতরে প্রলয়ংকারি ঝড় ওঠে, সবকিছু ভেঙে পড়ে তার উপর, তার সামান্য টিকে থাকা সম্ভ্রমও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, সে জর্জরিত ক্ষতিগ্রস্ততা নিয়ে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তার চিৎকারের কোনো শব্দ হয় না।

এখন জীবনের অদম্য দুঃখগুলো নিয়ে আবদুর রহিম নিজের ছায়াটাকেই ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে ছোটবেলার মতোই বারবার ব্যর্থ হয়। সকল ব্যর্থতা তাকে ঘিরে ধরে

আবদুর রহিম কিছুই করেনি, কিছুই বলেনি। হ্যাঁ, সে একটা কিছু বলেছে। শুধু সে একটা সত্য বলেছে। এই সত্য বলার ভয়ে সে তটস্থ হয়ে থাকে সবসময় এই বুঝি প্রতিবেশীদের কেউ কেউ এসে শাঁসিয়ে যাবে তাকে । তার ঘুমের ভেতরেও সে তটস্থ হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হুলস্থুল অস্থিরতা নিয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। চায়ের দোকানে জমায়েত দেখে মনে হয় তারা বুঝি তাকে নিয়েই কিছু একটা বলছে। আবদুর রহিম কোনো সমাগমের সামনে উপস্থিত হলে সবাই কেমন যেন চুপ হয়ে যায়, কি যেন একটা কিছু লুকায় তারা, মুহূর্তেই একে অপরের সাথে ভিন্ন কোনো বিষয়ে কথা বলে অথচ আবদুর রহিম বুঝতে পারে তাদের আলাপের বিষয় ছিলো অন্য কিছু। আবদুর রহিম কে দেখে সমাগমের লোকজন কেউ কিছু বলে না, তার উপস্থিতিও সেখানে কোনো প্রভাব ফেলে না। সবাই একে অপরের দিকে চেয়ে থেকে ভিন্ন আলাপ শুরু করে কিন্তু তার দিকে কেউ ভ্রুক্ষেপও করে না। 

আবদুর রহিম সত্যিই নিজেকে এখন ছায়া ভাবতে শুরু করে। আবদুর রহিমের ছোটবেলার কথা মনে হয়। ছায়ার সাথে খেলা করার কথা মনে হয়। সে কত আনন্দ নিয়ে ছায়াগুলো ধরতে যেত, আর ছায়াগুলো ক্রমেই দূরে সরে যেত। এখন জীবনের অদম্য দুঃখগুলো নিয়ে আবদুর রহিম নিজের ছায়াটাকেই ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে ছোটবেলার মতোই বারবার ব্যর্থ হয়। সকল ব্যর্থতা তাকে ঘিরে ধরে। তার চোখ গুলিয়ে আসে, মাথা ঝিম ঝিম করে। সেদিন সে কোনোমতে নিজেকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। বিছানায় নিজের শরীরটাকে শুইয়ে দেয় আলগোছে। সারারাত তার ঘুমের ভেতর সে অসংখ্য ছায়া দেখতে পায়। ঘুমের মধ্য সমগ্র পৃথিবীটা যেন কালো কালো ছায়ায় রুপ নেয় তার কাছে।

ঘুম মানুষের ক্লান্তি দূর করে। কিন্তু আবদুর রহিমের মনে হয় ঘুম তার কাছে দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে আবার জেগে থাকাটাও তার কাছে অসহ্য লাগে। কি করবে আবদুর রহিম বুঝতে পারে না। বাড়ি থেকে বের হয়ে সে গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া যমুনা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। অল্প অল্প আলো ফুটে উঠেছে চারপাশে। হালকা বাতাস তার শরীরে লাগলে অল্প একটু কেঁপে উঠে তার শরীর। আকাশে হালকা নীলের বিচ্ছুরণে নদীর জলও নীলরঙ ধারণ করে আছে। এমন নীল রঙের বিচ্ছুরণে আবদুর রহিম নিজের ছায়াটি দেখতে পায় নদীর জলে। নিজের ছায়াটি নদীর জলে দেখে বড় মায়া হয় তার। যেন জীবনের সমস্ত মায়া সে তার ছায়াটির ভেতর দেখতে পায়। 

আবদুর রহিম তারপর সেই জলের ছায়ার ভেতর তার ছোট মেয়ের ছবিটি দেখতে পায়। ক্রমে ক্রমে আবদুর রহিম তার পিতা মরহুম তোরাব আলী প্রামানিকের ছায়ার প্রতিবিম্বটিও দেখে ফেলে। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আর। যেন সমস্ত সকালের হাওয়া পেছন থেকে ঠেলে দিচ্ছে তাকে সেই জলের ভেতর।


আবদুর রহিম বুজতে পারে না একটা সত্য বলার কারণেই কি এমন হচ্ছে তারসাথে নাকি এতসব ঘটনা এই নীলজলের বিচ্ছুরণ, ছায়া-ঘুম কোনোকিছুই তার সাথে ঘটছে না। হয় তো একটা ঘোর স্বপ্নের ভেতর সে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। সবকিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিন্তু আবার পরক্ষণেই ভ্রম কাটে তার। এসবকিছু বাস্তবের ভেতরেই ঘটছে স্বপ্ন নয়। 

আবদুর রহিম ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে জলের ভেতর অথচ সে জল থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজছে না কিংবা কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিন্তু শিশু কিশোরদের নদীর জলে হইহুল্লোড়ের আওয়াজ তার কানে আসছে। সে সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। দূর থেকে আরও একটা আওয়াজ তার কানে আসতে আসতে জলের ভেতর  ঘূর্ণি খেয়ে হারিয়ে যায়। সে অল্প অল্প শুনতে পাচ্ছে সবাই সমস্বরে বলছে, দুয়ারে আইসাছে পালকি/ নাইয়রি যাও তুলো রে তুলো মুখে/ আল্লাহ রসুল সবে বল/ ও মুখে আল্লাহ রসুল সবে বল।